তেজস্ক্রিয়তার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন ম্যারি কুরি—

একজন বিজ্ঞানী যিনি শুধু যুগান্তকারী আবিষ্কারই করেননি, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বিজ্ঞানের তরে। তিনিই ইতিহাসের প্রথম মানুষ, যিনি পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন—দুই ভিন্ন শাখায় নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বৈজ্ঞানিক পরিসরে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর গবেষণার পথ মসৃণ ছিল না। কষ্ট, ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তার ছায়া তাঁর যাত্রার প্রতিটি ধাপে ছিল সঙ্গী। ১৮৯৮ সালে, স্বামী পিয়েরে কুরির সঙ্গে মিলে তিনি আবিষ্কার করেন দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল—পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম। এই আবিষ্কার তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ক আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে। তবে তখন তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা প্রায় অজ্ঞ ছিলেন। ফলে, কোনো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই কুরি ও তাঁর স্বামী দিনের পর দিন গবেষণাগারে রেডিয়েশনের সঙ্গে কাজ করে গেছেন। ম্যারি কুরি নিজেই রেডিয়ামের প্রতি এতটা মুগ্ধ ছিলেন যে, রাতের আঁধারে এর জ্যোতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে তা নিজের ডেস্কে রেখে দিতেন। এমনকি, পকেটে করে রেডিয়াম নিয়ে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়—তখনো তিনি বুঝতে পারেননি এর ভয়ংকর পরিণতি। বহু বছরের তেজস্ক্রিয় সংস্পর্শ শেষ পর্যন্ত তাঁর শরীরের ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে। হাড় ক্ষয়, রক্তের অসুস্থতা এবং শেষ পর্যন্ত aplastic anemia নামক দুরারোগ্য রোগ তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি টানে ১৯৩৪ সালে, মাত্র ৬৬ বছর বয়সে। তাঁকে প্রথমে ফ্রান্সের সোল এলাকায় স্বামীর পাশে একটি সাধারণ কফিনে সমাহিত করা হয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালে, ফরাসি রাষ্ট্র তাঁকে ‘পঁথেওন’-এ স্থানান্তর করে জাতীয় সম্মান প্রদান করে। সেসময় জানা যায়, মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর দেহাবশেষে তেজস্ক্রিয়তা রয়ে গেছে, যার ফলে তাঁকে পুনরায় সীসার তৈরি কফিনে সমাহিত করা হয়। আজও ম্যারি কুরির ব্যবহার করা নোটবুক, যন্ত্রপাতি, এমনকি তাঁর পোশাক পর্যন্ত এতটাই তেজস্ক্রিয় যে, সেগুলো বিশেষ সীসার বাক্সে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এগুলোর কাছাকাছি যেতে হলে গবেষকদের রেডিয়েশন প্রতিরোধী পোশাক পরে অনুমতি নিয়ে এগোতে হয়। তাঁর এই আত্মত্যাগ ও বৈজ্ঞানিক অবদান আজও বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে জ্বলজ্বল করছে।